একথা অবশ্য সত্যি যে স্বাভাবিক ভোজনে এবং ওজনে জীবন জীবন ক্ষয়ের কারণ সাধারণত দেখা যায়না। এ বিষয়ে গবেষকদের নানা অভিমত। কেউ কেউ এই অতি ভোজন এবং অতি ওজনের বিষয়টি বংশগতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান। কিন্তু বংশগতির ঘরে পৌঁছেও সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়না। আর বংশগত প্রভাবই যদি এর কারণ হয় ,তাহলে মোটা হওয়া রোধ করা,ওজন কমানো এবং সংশ্লিষ্ট মারাত্মক রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়া মোটা মানুষের ভাগ্যে নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের এমন অভিমতও পাওয়া যায় যে,বংশগতির চেয়েও পরিবারের প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস পরিবেশ অর্থনৈতিক কারণ দেহচালনার অভ্যাস ইত্যাদি বিষয়গুলি গভীরতর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মোটাসোটা ছেলেমেয়ের মা বাবা সাধারণত তাদের স্বাভাবিক ওজন সহপাঠীদের মা বাবাদের তুলনায় মোটাসোটা ও ওজনদার হয়ে থাকে। এইসব তথ্য থেকে মনে করা হয়, পরিবেশের প্রভাব একই টেবিলে মা বাবার খাদ্যাভ্যাস ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকখানিই সঞ্চারিত হয়ে থাকে। শৈশব বা কৈশোর থেকেই যদি সচেতনভাবে অতি ভোজনের প্রবণতা সৃষ্টি হয়ে যায়। তবে সময়ের সাথে সাথে ক্রমশ অবচেতনে সঞ্চারিত হয়ে সমস্থির হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের এই অভ্যাস ক্রমশ শরীরক্রিয়ার অংশ হয়ে গেলে এই অভ্যাসের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া খুবই কঠিন। অবশ্য মনোবিজ্ঞানীদের অনেকেই প্রায় অনুরুপ অভিমত পোষন করেন। তাদের মতে ঘরভাঙা ঘরের প্রতিকুল পরিবেশে যে ব্যক্তিত্ব বিপর্যয় ঘটায় তাই অতি ভোজনের প্রবণতা ও স্থুলতার জন্য দায়ী। সম্ভবত অবচেতনের প্রভাবে এরা অন্যপথে মনের অতৃপ্তি ও অশান্তি দূর করার চেষ্টা করে। আর সেপথ হলো রকমারী স্বাদু খাওয়া দাওয়া, কখনও বাড়াবাডি রকমের খাওয়া দাওয়া। হঠাৎ কোন কারণে ডিপ্রেশানে আক্রান্ত হলে খাওয়ার ইচ্ছে বেড়ে যায় এমন মানুষ কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়। অতি আহার ও ওজন বৃদ্ধির সমস্যার জটিল কারণ যাইহোক না কেন, এর বাস্তব পরিণতি আমাদের এক বিপজ্জনক পথের বাঁকে এনে ফেলে। অতিস্থুলতা ও অতি ভোজনের সাথে সংশ্লিষ্ট রোগগুলোর কাজই হচ্ছে তাড়াতাড়ি আয়ূর মাথায় আঘাত করা। রোগগুলি পুরোপুরি সারেনা। ওষুধ ও নিয়মকানুনের শাসনে চুপচাপ নিরিহ মুখ করে বসে থাকে আর একটু সুযোগ পেলেই নিষ্ঠুর থাবা বসিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,আমাদের অতিচেনা করোনারী হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়বেটিস। অন্যান্য কারণ সত্ত্বেও অতিভোজন ও অতি ওজনের সাথে এদের আত্মীয়তা নেহাৎ কম নয়। অবশ্য রোগা মানুষদের কি এসব রোগ হয়না? নিশ্চয়ই হয়। তবে এসব রোগের সঠিক একক কারণ এখনও নিশ্চিত করে জানা যায়নি । সম্ভবত একাধিক কারণে দীর্ঘদিন ধরে এদের পেছনে নিঃশব্দে কাজ করে যায়। অনেকটা নেপথ্য শিল্পীর মত। তবে একথা ঠিক যে হাল্কা পাতলা লোকের তুলনায় মোটাসোটা লোকের আক্রান্ত হবার আশঙ্কা অনেকগুন বেশী। শুধু আশঙ্কাই নয়,বিভিন্ন সমিক্ষা ও পরিসংখ্যানে এদেরকে অধিকতর সংখ্যায় আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। তাই এই সম্ভাব্য টার্গেটের দিকে এগিয়ে না যাওয়াই ভাল। অতএব অতিমাত্রায় আহারের প্রবণতা এবং ওজনবৃদ্ধির প্রবণতার প্রতি নজর রাখা, মাঝে মধ্যে শরীরের ওজনের কাঁটাটা সঠিক মাত্রায় আছে কিনা সেটা দেখা অবশ্যই জরুরী। শুধু রোগের কথাই নয় সৌন্দর্য তত্ত্বের দিক থেকেও তো সুঠাম দেহসৌষ্ঠব বজায় রাখা জরুরীও বটে। আমেরিকার কয়েকটি ক্লিনিকের হিসাবে দেখা যায়, একজন মোটাসোটা লোক দিনে মাত্র হাজার ক্যালরী খেয়েও দিব্যি সুস্থ থাকতে পারে এবং তাতে সপ্তাহে ২/৩ কেজি ওজন কমতে পারে। এই সঙ্গে হাঁটা,শরীরচালনা ইত্যাদি কাজ যোগ করলে ওজন আরও তাড়াতাড়ি কমতে থাকে। শ্রম ও মিতাহারই ওজন কমানোর নির্ভরযোগ্য বন্ধু,অন্য কিছু নয়। আমরা ক্রমশ নাগরিক জীবনে প্রবেশ করছি বেশ দ্রুত পায়ে আর ওজনের সমস্যাটা প্রধানত নাগরিক জীবনযাপনের সমস্যা। সময়ের বড় অভাবআমাদের। জাঁদরেল অফিসার থেকে শুরু করে নিরীহ কেরানী পর্যন্ত সবাই টেবিলে বসে সাত আট ঘন্টা উর্দ্ধশাসে কলমপেশা আর ফাইলে ডুবে থাকার কাজে বছরের প্রায় তিনশত দিন কাটিয়ে দেই। শরীর চালনার প্রশ্ন এখানে অবান্তর। অবশ্য অর্থনীতির সাঁড়াশী যদিও শক্তভাবে আমাদের ধরে রাখে যার ফলে অন্তত বছরে একবার দেশের ভেতরে বা বাইরে ঘর ছেড়ে পা বাড়ানো সম্ভব হয়না। সম্ভব হয়না হৃদপিন্ড ও ধমনীর পেশীগুলোকে শিথিল শয়ানে ছেড়ে দেওয়া। তবে ইদানিং এই ব্যবস্থার বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সে যাক,প্রতিদিন নিয়মিত সময়ে শ্রম ও শরীর চর্চায় নিঃসন্দেহে ব্যয় করা যায়। এজন্য দরকার সদিচ্ছা এবং নিয়মনিষ্ঠা। জীবিকার বিদঘুটে ধরণ ধারনের পাশাপাশি খাদ্য সচেতনতার অভাবও আমাদের কম নয়। জিহ্বার স্বাদের কাছে পুষ্টিবিজ্ঞানের রীতিনীতি কোথায় যেন ভেসে যায়। খাদ্যাভ্যাসের প্রকৃতিও আমাদের সঠিক নয় ফলে মধ্য বয়সেই শরীর ঢিলেঢালা, ওজন বৃদ্ধি, দেহে চর্বির ঢল এবং ক্রমে নানান রোগের উপসর্গ। তাই জীবিকার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। দরকার সঠিক খাদ্য নির্বাচন এবং জীবন যাপনের ধারার সংগতি বিধান। শ্রমজীবি সমাজে এই সমস্যা নেই। তাই মনে রাখা উচিত যে অতি মাত্রায় আহার স্থুলতা ও ওজনবৃদ্ধি এমন একটি অস্ত্র যা অনায়াসে আমাদের দেহের দুর্বলতম অংশে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে এবং জীবন বিপন্ন করে তুলতে পারে। তবে এই আঘাত আমরা ইচ্ছা করলেই ঠেকাতে পারি এবং জীবনের নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা নিতে পারি। তাই সকলের সেই চেষ্টা করাই শ্রেয় বলে মনে হয়।
লেখিকা: ডাঃ শওকত আরা বীথি।
ভূতপূর্ব চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার,এপিডেমিওলজী, আই,ই, ডি, সি,আর,স্বাস্হ্য অধিদপ্তর,মহাখালী,ঢাকা। (যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী)।
পূর্ববর্তী খবর