মেহেরপুর প্রতনিধি;
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার পোড়াপাড়া গ্রামের বালু ব্যবসায়ী লাল্টু মিয়ার (২৫) মৃত্যু রহস্য উন্মোচনের পথে। ট্রাক্টর চাপায় লাল্টুর মৃত্যু আর প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে ট্রাক্টর ট্রলি চালক আরিফুল ও ইমন এবং ট্রাক্টর ট্রলি মালিক টুটুল হোসেন। মেহেরপুর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে শুক্রবার (০২ জুন) তারা এ স্বীকারোক্তি দেয় বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। লাল্টুর মৃত্যুর ঘটনার মামলার প্রধান আসামি আরিফুল, সহযোগী বালু ব্যবসায়ী টুটুল হোসেন ও ট্রাক্টর চালক ইমনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছে পুলিশ।
গ্রেফতার আরিফুল ইসলাম চিৎলা গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে। বালু ব্যবসায়ী টুটুল ও ট্রাক্টর চালক ইমনের বাড়ি গাংনী পৌরসভাধীন চৌগাছা গ্রামে। টুটুল হোসেন চৌগাছা গ্রামের মোল্লাপাড়ার নুর মোহাম্মদ মোল্লার ছেলে।
তিন আসামির স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে গাংনী থানার পরিদর্শক তদন্ত মনোজ কুমার নন্দী জানান, ঘটনার পর ট্রাক্টর চালক আরিফুল ও ইমন এবং বালু ব্যবসায়ী টুটুল মিলে ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে। তাদের তিন জনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। বিজ্ঞ আদালত ১৬৪ ধারায় তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী রেকর্ড করেছেন। আদালতের নির্দেশে তাদেরকে ওই মামলার আসামি হিসেবে মেহেরপুর জেলা কারাগারে প্রেরণ করেছে পুলিশ।
প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পুলিশ জানায়, তিন আসামির স্বীকারোক্তিতে ঘটনার আসল রহস্য উন্মোচনের পথে। তাদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, চৌগাছার টুটুল হোসেন ও পোড়াপাড়া গ্রামের লাল্টু মিয়া একসঙ্গে বালু ব্যবসা করতেন। চৌগাছা ভিটাপাড়া থেকে মাটি-বালু নিয়ে বাঁশবাড়ীয়া বাজারের পশ্চিমপাশে একটি নিচু জায়গা ভরাট করা হচ্ছিল। দিনের বেলায় রাস্তায় যানবাহনের চাপ থাকায় সারারাত ধরে দুটি ট্রাক্টরে বালু ফেলার কাজ চলছিল কয়েক রাত থেকে। যেখানে সারারাত অবস্থান করে বালু ফেলতে ট্রাক্টর ট্রলি চালকদের সহায়তার দায়িত্বে ছিলেন লাল্টু মিয়া।
জানা গেছে, ঘটনাটি সেদিন রাত সাড়ে তিনটার দিকে। ট্রাক্টর চালক আরিফুল ইসলাম ট্রাক্টর ট্রলি নিয়ে বালু ফেলার জন্য প্রবেশ করে। এসময় ট্রাক্টরের পেছনে দাঁড়িয়ে বালু ফেলার স্থান দেখিয়ে দিচ্ছিল লাল্টু মিয়া। এক পর্যায়ে অসাবধনতা বশত ট্রাক্টরের চাকার নিচে চাপা পড়ে লাল্টু। তার দুই পায়ের উরু আর কোমর আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বিষয়টি টের পেয়ে লাল্টু ট্রাক্টর থেকে নেমে গিয়ে লাল্টুর মাথা ও মুখে পানি দেয়। তবে তার শারীরিক অবস্থা বেগতিক দেখে অপর ট্রাক্টর চালক ইমনকে মোবাইলে কল দিয়ে ট্রাক্টর ট্রলি মালিক টুটুল হোসেনেকে জানাতে বলে আরিফুল। খবর পেয়ে ইমনকে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে যায় টুটুল। ইমন, টুটুল ও আরিফুল মিলে লাল্টুকে সুস্থ করার চেষ্টা করে। এর মধ্যে আরিফুলকে ঘটনাস্থল থেকে ট্রাক্টর ট্রলি নিয়ে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয় টুটুল।
এদিকে ভোর চারটার দিকে টুটুল ও ইমন মোটর সাইকেলযোগে গাংনী হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এর আগে আহত লাল্টু মিয়াকে একটি ভ্যানে তুলে দেয় তারা। হাসপাতালের সিসি টিভি ক্যামেরার রেকর্ড অনুযায়ী ৪টা ২১ মিনিটে তারা লাল্টুকে নিয়ে গাংনী হাসাপাতালে পৌঁছায়। জরুরী বিভাগের চিকিৎসক লাল্টুকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কুষ্টিয়া নেওয়ার পথে মিরপুরে পৌঁছুলে মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়ে লাল্টু মিয়া।
ঘটনাটি কেন আড়াল করা হয়েছে এ বিষয়ে ট্রাক্টর ট্রলি চালক আরিফুল ইসলাম বিষয়টিকে দুর্ঘটনা হিসেবে দাবি করে এবং ভয় পাওয়ার কারণ উল্লেখ করেছে। আরিফুল পুলিশকে জানায়, ঘটনার পর সে খুবই ভীতু হয়ে পড়ে। এসময় টুটুল তাকে সাহস দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। ট্রাক্টর ট্রলি বাড়িতে রেখে আত্মগোপন করতে নির্দেশ দেয় টুটুল। নির্দেশনা মতো আরিফুল বাড়িতে ট্রাক্টর ট্রলি রেখে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা এলাকায় আত্মগোপন করেছিল।
এদিকে মরদেহ উদ্ধারের পর লাল্টুর পরিবারের লোকজন প্রতিবেশীদের দিকে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তোলে। যার জের ধরে তারা গাংনী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে। ওই মামলার প্রধান আসামি ট্রাক্টর ট্রলি চালক আরিফুল ইসলাম। অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেফতার হয় বালু ব্যবসায়ী টুটুল হোসেন ও অপর ট্রাক্টর ট্রলি চালক ইমন হোসেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লাল্টু মিয়ার হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে তার মা সুকজান খাতুন বাদি হয়ে আট জনের নামে মামলাটি দায়ের করেন। মামলার অপর আসামিরা হচ্ছে- তার প্রতিবেশী আনছার আলীর মেয়ে মমতাজ খাতুন, মোশাররফ হোসেনের ছেলে আলমাস ও জাব্বারুল, লালু মিয়ার ছেলে জনি ও জসিম এবং দাউদ হোসেনের ছেলে বাদশা।
অভিযোগ রয়েছে, আনছার আলীর ওয়ারিশদের সাথে সুকজান খাতুনের জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। এ নিয়ে মামলা চলমান রয়েছে। আনছার আলীর ওয়ারিশদের পক্ষের একটি মামলার যারা স্বাক্ষী ছিলেন তাদেরকে শায়েস্তা করতেই সুকজান খাতুন মিথ্যা হত্যা মামলা দায়ের করেছে। ট্রাক্টর চালক আরিফুল ও ইমন এবং লাল্টুর ব্যবসায়িক পার্টনার টুটুল হোসেনের স্বীকারোক্তিতে প্রকৃত ঘটনা উঠে এসেছে।
গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক জানান, বাদির দায়ের করা হত্যা মামলা তদন্ত করা হচ্ছে। মামলা তদন্ত সম্পন্ন হলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।
প্রসঙ্গত, বুধবার ভোরে বাঁশবাড়ীয়া বাজারের পাশে ট্রাক্টর ট্রলিতে মাটি ফেলার কাজের কাছে অবস্থান করার সময় পোড়াপাড়া গ্রামের বালু ব্যবসায়ী লাল্টু মিয়ার মরদেহ উদ্ধার হয়েছে মর্মে জানতে পারে তার পরিবার। গুরুতর আহত অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া নেওয়ার পথে মারা গেছে মর্মে দাবি করে বালু ব্যবসায়ী টুটুল হোসেন মরদেহ তার পরিবারের কাছে দিয়ে আসে। এক পর্যায়ে পরিবারের লোকজন অভিযোগ তোলে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিবেশী আনছার আলীর লোকজন তাকে হত্যা করেছে। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে হত্যাকাণ্ডের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। অভিযুক্তদের নামে হত্যা মামলা রেকর্ডের চাপ অন্যদিকে মানুষের মাঝে হত্যকাণ্ডের বার্তা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে বিপাকে পড়ে পুলিশ। তবে বুধবার দিনভার বিষয়টি নিয়ে নানাভাবে তদন্ত করে পুলিশের কাছে স্পষ্ট হয় ঘটনাটি ভিন্নখাতে নেওয়া হচ্ছে। অবশেষে গভীর রাতে ট্রাক্টর ট্রলি চালক আরিফুল ও ইমন এবং বালু ব্যবসায়ী টুটুল হোসেন পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তির পরে প্রকৃত ঘটনা সামনে আসে।