ডাঃ শওকত আরা বীথি
রিউমেটিক জ্বর’ এর বিষয়ে আরও কয়েকটি তথ্য জানা প্রয়োজন। যেমনএর বিশেষ বিশেষ লক্ষণগুলি। আর সেটি হচ্ছে জ্বরের সাথে প্রচুর ঘাম হওয়া এবং সেইসাথে কয়েক সপ্তাহ আগে টনসিল বা ফ্যারিংস এ প্রদাহের ইতিহাস দিয়ে থাকেন অভিভাবকগণ। দ্বিতীয় প্রধান লক্ষণ হচ্ছে অস্থিসন্ধির প্রদাহ। শুধুমাত্র গাঁটে ব্যাথাই নয় গাঁট লাল হওয়া,গরম হয়ে ফুলে যাওয়া।এক বা একাধিক বড় অস্থিসন্ধি যেমন হাঁটু গোড়ালী কনুই ইত্যাদি একের পর এক আক্রান্ত হতে থাকে। দ্বিতীয় বা তৃতীয়টি আক্রান্ত হবার পর প্রথমটির উপশম ঘটে এমনি এক জয়েন্ট থেকে অন্য জয়েন্টে প্রদাহ হওয়া এই রিউমেটিক জ্বরের এক বিচিত্র বৈশিষ্ট। আর একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হচ্ছে জ্বরের অনুপাতে নাড়ীর গতিধারা অপেক্ষাকৃত বেশী থাকা। এবং নিশ্চিত লক্ষণ হচ্ছে এইসব লক্ষণের সাথে ,ই এস আর এর মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই মনে করেন অন্যান্য আরো অনেক রোগের মতই রিউমেটিক জ্বরেও রক্তে ই এস আর এর মাত্রা বাড়বেই এতে কোন ভূল নেই। কিন্তু আবার এই জ্বরে ‘এ এস ও’ টাইটারও বেড়ে যায় ।কিন্তু ‘এ এস ও’ টাইটার বেড়ে যাওয়া মানেই রিউমেটিক জ্বর নয়। যদি সেখানে রিউমেটিক জ্বরের অন্ততঃ গোটা দুয়েক প্রধান লক্ষণ উপস্থিত না থাকে। কাজেই রিউমেটিক জ্বরের অন্যান্য লক্ষণের অনুপস্থিতিতে বর্ধিত ‘এ এস ও’ টাইটার দিয়ে রিউমেটিক জ্বর ভেবে নিয়ে বৃথা আতঙ্কিত হওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। সন্দেহ নেই রিউমেটিক জ্বরের প্রধান শিকার হলো হৃদযন্ত্র। এই সম্পর্কে একটি মজার কথা বলা আছে যে। রিউমেটিক জ্বর সন্ধিগুলোকে চাটতে থাকে বটে! কিন্তু নিশ্চিত কামড় বসায় হৃদযন্ত্রকে। এই প্রক্রিয়ায় হৃদপিন্ডের বিভিন্ন আবরণ বা স্তর তো আক্রমণ করেই।বিশেষভাবে হৃদপিন্ডের ভেতরে ছোট ছোট ভাল্ব গুলোকে দীর্ঘকালিন আক্রমণের মধ্য দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে বিকৃত চেহারার করে দেয়। যাতে করে ভাল্বগুলি সঙ্কুচিত হয়ে গিয়ে হৃপিন্ডের কাজে দীর্ঘকালীন ব্যাঘাত করে,ক্রমে ক্রমে নিষ্ক্রিয়তার পালা শুরু হয়। হৃদপিন্ডের মাইট্রাল ভাল্বের প্রায় বন্দ হয়ে যাওয়ার অবস্থার নাম “মাইট্রাল স্টেনোসিস”। এ ক্ষেত্রে সার্জারীর মাধ্যমে ঐ নষ্ট ভাল্ব ফেলে দিয়ে নতুন ভাল্ব লাগিয়ে দেওয়া হয়। যা কিনা বেশ ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। সাধারণ মানুষের পক্ষে খুব কঠিন সমস্যা বটে। এই অবস্থা থেকে রিউমেটিক হৃদরোগের গুরুত্ব বুঝতে পারা সম্ভব। আর তাই রিউমেটিক জ্বর ও তার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে ফেলতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চালাতে হয় জীবানুকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার জন্য। আর এই ব্যাপারে দায়িত্ব যেমন চিকিৎসকের তেমনি অভিভাবকদেরও। রিউমেটিক প্রক্রিয়ার কিছু অবশিষ্ট রয়ে গেল কিনা সেটা সাধারণতঃ খুব সহজে দুই একটা পরীক্ষা দ্বারা বোঝা যায়। যেমন নাড়ীর গতিহার এবং রক্তে ই এস আর এর হার পরীক্ষা করে। এই রোগের ওষুধও এমন কোন দামী ওষুধ নয় । চিকিৎসার প্রধান অঙ্গ হলো ট্যাবলেট পেনিসিলিন ও ট্যাবলেট এ্যাসপিরিন। পেনিসিলিন সিরাপ ও ইনজেকশান হিসাবেও দেওয়া যেতে পারে। ট্যাবলেট বা সিরাপ দিনে দুবার খেতে হয়। আর ইনজেকশান প্রতিমাসে একবার মাংশপেশীতে দিতে হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ক্রমেই ওষুধ বন্দ করা উচিত নয়। সবশেষে তাই আবারো বলতে চাই যে এর হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বাতজ্বর ও তার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করে ফেলতে হয়। তাই ছেলে মেয়ে কারও এই রোগ দেখা দিলে অথবা ক্রনিক টনসিল প্রদাহের মত রোগ থাকলে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত ওদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এছাড়া পরিবারের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মাঝে স্বাস্থ্যবিধিগুলো ঠিকমতত চালু রাখা প্রয়োজন। যেমন প্রত্যেকবার খাওয়ার পর তুলি করা ,মুখ পরিষ্কার করা,ভালভাবে দাঁত মাজার অভ্যাস করা এবং রাতে ঘুমাতে যাবার আগেও দাঁত মাজার অভ্যাস করা জরুরী। এছাড়া একজনের খাবার অন্যজন না খাওয়া একই গ্লাসে অন্যজন পানি না খাওয়া ইত্যাদি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেও এই রোগের জীবানুর সংক্রমন বৃদ্ধি পায়। তাই এইসব পরিবেশ থেকে ছেলেমেয়েদেরকে দূরে রাখতে হবে। তাহলে টনসিল প্রদাহ বা সংক্রমিত ফ্যারিংস থেকে বাতজ্বরে আক্রান্ত হবার আশংকা অনেকাংশেই কমে যাবে এবং পরবর্তী জীবনে রিউমেটিক হৃদরোগ থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভবপর হবে।