-মুহম্মদ রবীউল আলম
আন্দোলন সংগ্রামের সুতিকাগার ঐতিহ্যবাহী মেহেরপুর।প্রাচীন ও মধ্যযুগের নানা আন্দোলন, আধুনিক যুগের নীল বিদ্রোহ ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনের সাক্ষী এই মেহেরপুর। ১৯৭১ –এ মেহেরপুর ছিলো মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র। ১৭ই এপ্রিলে এই মেহেরপুরের মুজিবনগরে(বৈদ্যনাথতলা)মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন এবং স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। ২৬মার্চ থেকে ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত মেহেরপুর ছিলো ছিল মুক্তাঞ্চল। ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মেহেরপুরের দখল নেয়। এরপর মাসের হিসেবে সাড়ে আট মাস ঐ হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা মেহেরপুরের মানুষের ওপর হত্যা, নির্যাতন ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চাল্য়া। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা দফায় দফায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অবশেষে ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর মুক্ত হয়। দেখেছি সেই বিজয়, দেখেছি এই বিজয়ের আগে যত আন্দোলন ও সংগ্রাম। দেখেছি বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে এখানে আসতে এবং বক্তব্য দিতে।
৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের ঘটনাবলী তুলে ধরার আগে তুলে ধরতে চাই স্বাধীনতা আন্দোলনে মেহেরপুরের প্রেক্ষাপট। বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম,৪৭ সালের ভারতবর্ষ ভাগ,ভাষা আন্দোলন,১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনসহ বিভিন্ন আন্দোলনের মেহেরপুরবাসী ভূমিকা রেখেছে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মেহেরপুর থেকে নির্বাচিত হন এডভোকেট মোঃ আব্দুল হান্নান। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান রাজনীতি বন্ধ করলেন। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছয় দফা ঘোষণা করলেন।১৯৬৯ সালেগণ অভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতনের পর ক্ষমতায় এলেন ইয়াহিয়া খান।১৯৬৯ সালে আন্দোলনের এক পর্যায়ে মেহেরপুর পৌর পার্কের নামকরণ করা শহীদ সামসুজ্জোহা পার্ক।। ৭০-এর নির্বাচনে মেহেরপুরে জয়লাভ করলেন আওয়ামীলীগের প্রার্থী মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন। পাকিস্তানে জয় লাভ করলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলেন।১৯৭১ সালের শুরুতে মার্চে শুরু হলো পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন। দেখেছি সেই মার্চের উত্তাল আন্দোলন। তখন বাঙালীর মুখে মুখে শ্লোগান ছিল,‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভাষণ দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। মেহেরপুরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভুমিকা পালন করলেন।
আমি বিজয় দেখেছি মেহেরপুরে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর।বিজয় মানে আনন্দ, বিজয় মানে উচ্ছ্বাস। শত সহস্র কষ্টে অর্জিত আমাদের এই বিজয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর কেন্দ্রীক মেহেরপুববাসীর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। মুক্তিযুদ্ধ মানেই মুজিবনগর, মুক্তিযুদ্ধ মানেই এ অঞ্চলের মানুষের রক্তঝরা ত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস। এ অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষেকে সেদিন দেখেছি জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে।আজ বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের এই দিনে আজ আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি মেহেরপুরসহ সারা দেশের সেই নাম জানা অজানা শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধা, যারা বীরের মতো সংগ্রাম করে বিজয়ের পতাকা হাতে স্বাধীন দেশে বীরের বেশে প্রবেশ করে দেশ গড়ার কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছেন। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এ অঞ্চলের আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিবেদিত প্রাণ নেতা কর্মীদের ,যারা সপরিবারে দুঃখ দুর্দশা ও রোগ বালাই সহ্য করে ভারতের মাটিতে কষ্ট করে স্বাধীন দেশের বিজয়কে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৈৗধুরী, মেহেরপুর আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা এমএনএ মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন ও নূরুল হকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের অবদানকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।তৌফিক-ই-এলাহী চৈৗধুরী ১৯৭১ সালে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন, তা দেশবাসী চিরকাল স্মরণ করবে।
১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী পাকহানাদার বাহিনীর ওপরে ম্যারাথন আক্রমণ চালাতে থাকে। পাকহানাদার বাহিনী অবস্থা বেগতিক দেখে যুদ্ধ সরঞ্জাম গুটোতে থাকে। ওই দিনেই মুক্তিবাহিনী সকাল থেকে মেহেরপুরের পাকিস্তানী বাহিনীর আস্তানা লক্ষ্য করে চারদিক থেকে অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকে। এতে আহতও হয় বেশ কয়েকজন। ২৮ এবং ২৯ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর একের পর এক হামলায় হানাদার বাহিনী মেহেরপুরে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে পাকবাহিনী ৩০ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে গোপনে পিছু হটতে থাকে। বিতাড়িত হয়ে যাওয়ার পথে হানাদার বাহিনী আমঝুপি ব্রিজ ,দিনদত্ত ব্রিজের কিছু অংশ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে যায়। একই রাতে পালানোর সময় মুক্তিবাহিনীর মর্টার হামলায় কুলপালা নামক স্থানে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়।
১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর সকাল থেকেই মেহেরপুরের অনেক এলাকা হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়। ২ ডিসেম্বর গাংনী হানাদার মুক্ত হলে শিকারপুরে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর অ্যাকশন ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী হাটবোয়ালিয়ায় এসে মুক্তিবাহিনীর ঘাটি স্থাপন করে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে ৫ ডিসেম্বর মেহেরপুরে প্রবেশ করে। ১ ডিসেম্বর মেহেরপুর বিমুক্ত হলেও সীমান্তে পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা অসংখ্য মাইন অপসারণের মধ্য দিয়ে মেহেরপুর পুরোপুরিভাবে হানাদার মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। এই দিন সকালে মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করলে অবরুদ্ধ জনতা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে জয়ের উল্লাসে যোগ দেন।
মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রথম কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়। হোটেল বাজারে ইসমাইল হোসেন মন্ডল মানিক মিয়ার দোকানে আওয়ামী লীগের প্রচার কেন্দ্র খোলা হয়। সেখানে মাইকে বিভিন্ন নির্দেশনা,বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও দেশাত্ববোধক গান প্রচার হচ্ছিলো। হোটেলবাজার মসজিদের সামনে লাল বিল্ডিংয়ের পাশে ছিলো ছাত্রলীগের অফিস।সেখানেও ছিল মানুষের ভিড়। মানুষ সবাই ছিল চিন্তিত।কি করবে যেন ভেবে পাচ্ছিলো না। অপরদিকে গাংনী বাজারের অভ্যন্তরে একটি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করে মেহেরপুরের সাথে সার্বক্ষণিক সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়। স্বতঃস্ফুর্ত জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং তরুণ মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা মেনে পড়ে যায়।মানুষ সব পালাচ্ছে ,সবার চোখে মুখে ভয়। পরিস্থিতি কোন দিকে যায়? আমি তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্র। আমার বড় চাচা নঈমউদ্দিন শেখ আওয়ামী লীগের মেহেরপুর শহর কমিটির সাধারণ সম্পাদক। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে পরিবারের সবাই মিলে আশ্রাফপুর রসিকপুর হয়ে বাগোয়ানে গেলাম। বাগোয়ানে আমার নানার বাড়ি। সেখানে একদিন থেকে ভারতের হৃদয়পুর শরণার্থী শিবিরে গেলাম। আমার বড় চাচা নঈমউদ্দিন শেখ সপরিবারে সেখানে থেকে গেলেন। আর আমার আব্বা রইছউদ্দিন শেখ সেখানকার কষ্ট দেখে ফেরৎ এলেন এবং আমাদের গ্রামের বাড়ি গাংনীর গাড়াডোবের পাশে নিরিবিলি আযান গ্রামে আত্মগোপন করে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার বড় চাচা নঈমউদ্দিন শেখ একাত্তরের যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং আওয়ামী লীগ নেতা এমএনএ জননেতা মোহাম্মদ ছহিউদ্দিনের সাথে থেকে বেতাই ক্যাম্পে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। বড় চাচার পরিবার ছিল নদীয়া জেলার বড় আন্দুলিয়া গ্রামে। সেখানে বন্যার সময়ে তারা অনেক কষ্টের মধ্যে পড়েছিলেন। আমার আব্বা প্রায়ই সেখানে গিয়ে টাকা পয়সা দিয়ে আসতেন। আমাকে সাথে নিয়েও তিনি বড় আন্দুলিয়া গ্রামে গিয়েছিলেন। নিজের চোখে তাদের কষ্ট দেখে এসেছিলাম। আমার বড় চাচার ছেলে রেজাউলকে বন্যার মধ্যে সাপে কামড় দিয়েছিল। শরণার্থীদের এইসব দুঃখ কষ্ট দেখে খুব মানসিক কষ্টের মধ্যে পড়েছিলাম। আমি আব্বার সাথে দু‘বার তাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।যেতে গিয়ে একবার নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। পরে আব্বা আমাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। বিভিন্ন রোগ বালাই ও অভাব অনটনে মুক্তিকামী মানুষগুলোর দুঃখ দুর্দশার কথা আজো মনকে কাঁদায়। মনে পড়ে আমার আব্বা ভারতে এই সব শরণার্থীদের এইসব দুঃখ কষ্ট দেখে এসে একবার মারাত্মকভাবে অসুখে পড়ে গেলেন এবং দীর্ঘদিন রোগে ভুগে সুস্থ হন।
মনে পড়ে, সাহস করে মাঝে যুদ্ধকালীন সময়ে একদিন আব্বার সাথে পাকবাহিনী দখলকৃত মেহেরপুর শহরে গিয়েছিলাম। সাইকেলে চড়ে মেহেরপুর শহরে ঢুকতেই ওয়াপদা মোড়ে আর্মিরা সাইকেল থামিয়ে বললো ,‘হল্ট।’ আমি তো ভয়ে অস্থির। আমরা থামতেই তারা ভালোভাবে বডি চেক করলো এবং অবশেষে যাওয়ার অনুমতি দিলো। পরে আমরা বড়বাজার হয়ে হোটেল বাজার হয়ে আমাদের নিজের বাড়ি দেখে আসলাম। সব কিছু যেন অচেনা হয়ে গেছে। শহরে মানুষজন খুব কম, মাঝে মধ্যে আর্মিদের গাড়ি টহল দিচ্ছে। মানুষের মধ্যে চরম হতাশা ও দুশ্চিন্তা। অধিকাংশ দোকান বন্ধ। আমাদের ঘর-বাড়ি সব প্রায় জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বিকেলেই আবার আতংকের মধ্যেই ফিরে গেলাম ওয়াপদা মোড়,গাড়াডোব হয়ে আযান গ্রামে। গ্রামটি ছিল নির্জন। নয় মাস আমাদের তেমন কষ্ট হয়নি। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মাত্র একবার চিৎলা হয়ে আযান গ্রামের ভিতর দিয়ে হেটে গিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলে আমরা ফিরে গেলাম মেহেরপুরে এবং আমার বড় চাচা সপরিবারে ফিরে এলেন কিছুদিন পরে। অনেক কষ্ট ও সংগ্রাম করে চাচা দেশ স্বাধীনে ভূমিকা রাখলেন। আমার চাচার আবদানের কথা আমরা আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। দেশের জন্য তিনি জীবনকে বাজি রেখেছিলেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছুই করে যেতে পারেন নি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করে যাননি।মুক্তিযোদ্ধার কোন সুযোগ-সুবিধাও তিনি পান নি। বছর দশেক আগে চাচা অভাব অনটনের মধ্যে থেকেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন।তার ৫ছেলে ও ২ মেয়ে লেখাপড়া তেমন করতে পারেনি। অভাব অনটনের মধ্যেই তারা দিন যাপন করছে।
আমার বড় চাচা নঈমউদ্দিন শেখ ১৯৭১ সালে মেহেরপুর মহকুমা মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম কমিটির একজন সদস্য ছিলেন এবং মেহেরপুর শহর মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন। আমার আব্বা রইছউদ্দিন শেখ(ফইমউদ্দিন) এই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন।
মনে পড়ে,যুদ্ধের প্রস্তুতির সময়ের মেহেরপুর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিটিং মেহেরপুরের বাসষ্ট্যান্ডস্থ আমাদের বাড়ীর ছাদে অনুষ্ঠিত হতো।উপস্থিত থাকতেন এমএনএ মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন ও নূরুল হকসহ মেহেরপুর আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। অনেক রাত পর্যন্ত এই সব মিটিং চলতো। মুড়ি, চানাচুর, ছোলা ও পানি মিটিংয়ের খাওয়া ছিলো। মনে পড়ে, একদিন এক লোক দ্রুত মিটিংয়ে হাপাতে হাপাতে এসে বললো,‘আমি এক বিহারী পুলিশকে মেরেছি। এখন আমি কি করবো?’ নেতারা বললেন, ‘সমস্যা নেই, তুই এখন পালিয়ে যা।আমরা দেখছি।’ নেতাদের কথা শুনে সে দ্রুত আত্মগোপন করলো।
মনে পড়ে,১৯৭০ সালের ফ্রেরুয়ারি মাসে আমার বড় চাচা নঈমউদ্দিন শেখ আমার দুই চাচাতো ভাই রেজাউল ও কুদ্দুস এবং আমাকে নিয়ে ঢাকায় আসলেন এবং ধানমন্ডির ৩২ নং-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আমাদের মাথায় হাত বুলিয়েছিলেন এবং চকলেট খেতে দিয়েছিলেন। আমার চাচাকে তিনি বলেছিলেন,‘নঈমউদ্দিন তোমার ছেলেদের নিয়ে এসেছো-আমি খুশি হয়েছি। যাওয়ার সময় এদের প্লেনে নিয়ে যেও।’ সত্যিই চাচা প্রিয় নেতার কথামত আমাদের প্লেনে এনেছিলেন। প্লেনে আমরা ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী এসেছিলাম। তখন ঈশ্বরদী বিমান বন্দর চালু ছিলো। পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে যায়। ঈশ্বরদী থেকে কুষ্টিয়া হয়ে বাসে মেহেরপুরে গিয়েছিলাম। সেটাই ছিলো আমাদের প্রথম বিমান ভ্রমণ। মনে আছে, প্লেন উপরে উঠতেই আমি বমি করেছিলাম।বিমানবালা আমাকে অনেকগুলো চকলেট দিয়েছিলো এবং মুখ মুছে দিয়েছিল। এসব এখন স্মৃতি।
শেখ মুজিব এই এলাকাকে ভালোবেসে দু‘বার এসেছেন এবং মেহেরপুরের মানুষও তাকে গভীরভাবে ভালোবেসে তার আহবানে মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরখ্যাত মেহেরপুরকে দ্বিতীয় রাজধানীর মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে মুজিবনগরকে মূল্যায়নের জন্য লিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে সপরিবারে নিহত হওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন অধরা থেকে গেছে।
১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম মেহেরপুরে এলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মেহেরপুর পৌরসভার কালাচাঁদ মেমোরিয়াল হলের সামনে জনসভা করলেন। পরে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ৩১ আগষ্ট ১৯৭০ তিনি এলেন মেহেরপুরে। সাথে ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী।আমার সৌভাগ্য হয়েছিল, সেই সমাবেশে উপস্থিত থাকার। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। মনে পড়ে মঞ্চ সাজানো হয়েছিল পার্কের বর্তমান মেহেরপুর হলের সামনে। অর্থাৎ সোনালী ব্যাংকের সাথে লাগা কোনাটায়। সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমা আওয়ামীলীগ সভাপতি মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মুজিবনগরে বেশ কয়েকবার এসেছেন এবং মেহেরপুরের মানুষের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক। তিনি মেহেরপুর ও মুজিবনগরের উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। তিনি বলেছেন, মেহেরপুরের মানুষের জন্য আমি সাধ্যমত চেষ্টা করবো। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও মেহেরপুরের কৃতী সন্তান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের আন্তরিক চেষ্টায় মুজিবনগরে হচ্ছে স্বাধীনতা সড়ক ও চেকপোস্ট, হচ্ছে রেলপথ ও বেতার কেন্দ্র, হচ্ছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রকল্প। মেহেরপুরের মানুষ বর্তমান সরকারের প্রতি খুশি। তারা এই সব প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন চায়। মেহেরপুরের মানুষের প্রত্যাশা মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার মানুষের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মেহেরপুর,কুষ্টিয়া,চুয়াডাঙ্গা,ঝিনাইদহ,মাগুরা ও রাজবাড়ী নিয়ে করতে হবে মুজিবনগর বিভাগ। এই বিভাগের সদর দপ্তর হবে কুষ্টিয়ায়।
আমাদের বক্তব্য, মুজিবনগর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাজধানী। মুজিবনগর কোন দলের বা কোন গোষ্ঠীর নয়। অথচ মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত শপথ দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হলো না। একাত্তরের যুদ্ধে বাংলার মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিল মুজিবনগরকে ঘিরে। এই মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সরকারের শপথ ও স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়েছিল। নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করে মুজিবনগর সরকার। দেশের স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত সবই মুজিবনগরের অর্জন। অথচ এই মুজিবনগরের ১৭ এপ্রিলকে রাষ্ট্রীয় ভাবে উদযাপন করা হচ্ছে না। এই দিবসটি আওয়ামী লীগের দলীয় দিবসে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দিবসটি ঘটা করে পালিত হয়। আর অন্য দল ক্ষমতায় থাকলে দিবসটি তেমন পালিত হয় না। তখন আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে মুজিবনগর দিবস হিসেবে পালন করে। আমাদের দাবি এই দিবসটিকে জাতীয় শপথ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় ভাবে উদযাপন করা হোক। মনে পড়ে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই দিবসটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে রাষ্ট্রীয় ভাবে পালন করা হতো। তখন এই দিবসটির নাম ছিলো জাতীয় শপথ দিবস। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল ফিলাডেলফিয়ায়। মুজিবনগর বাংলাদেশের ফিলাডেলফিয়া।মুজিবনগরকে বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় রাজধানী’ হিসেবে ঘোষণা করে ফিলাডেলফিয়ার মতো ‘কিছু সরকারি দপ্তর’ সেখানে স্থাপনের দাবি করছি।
পরিশেষে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এই দিনে আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, জাতীয় চার নেতা, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সকল শহীদ সদস্যদের এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সারা দেশের সেইসব নাম জানা অজানা শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে।সেই সাথে এ দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদেরকেও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। এগিয়ে যাক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ।এগিয়ে বাংলাদেশের মানুষ।
লেখকঃ সাংবাদিক ও লেখক। মেহেরপুরের কৃতী সন্তান
ছবি-১৯৭১ সালে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুরে বিজয় উৎসব। মেহেরপুরের গণমানুষের নেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোহাম্মদ ছহিউদ্দিনের বাসার সামনে নতুন পতাকা উত্তোলন করে এই উল্লাস। মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন চেয়ারে বসে আছেন, তাই ছবিতে দেখা যাচ্ছে না। (ছবি সংগ্রহঃ মাসুদ রেজা, ছবির সূত্র-জাফর ওয়াজেদ-পিআইবি)। ( লেখক – সিনিয়র সাংবাদিক ও সাপ্তাহিক মুক্তিবানীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক)
পূর্ববর্তী খবর