স্বপ্ন রাই
(সাবেক অধ্যক্ষ, মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রী কলেজ)
আমাদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা অভিধান শ্রী হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ দ্বিতীয় খণ্ডে মাতৃভাষার যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেটা সর্বাঙ্গসুন্দর; আমাদের কোনও ব্যাকরণ বা অভিধান তার ধারে-কাছেও যেতে পারে নি; তবে অক্সফোর্ডের ইংরেজি অভিধান মাতৃভাষার যে সংজ্ঞা দিয়েছে, তা যেন হরিচণের সংজ্ঞারই অনুবাদ। এমনকি লেনার্ড ব্লুমফিল্ড তার Language নামক গ্রন্থের(১৯৩৩) ৪৩ পৃষ্ঠায় মাতৃভাষার যে সংজ্ঞা সাব্যস্ত করেছেন, সেটাও যেন হরিচণকেই অনুসরণ করছে। তবু আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্য ব্লুমফিল্ডের সংজ্ঞাটিই গ্রহণ করবো, কারণ তাঁর সংজ্ঞা ভাষাবিজ্ঞানসম্মত। তবে তিনি mother-tongue শব্দটা ব্যবহার করেন নি।
আমাদের অভিধানে, ‘মাতৃভাষা’র ইংরেজি mother-tongue, লেখা হয়েছে, অক্সফোর্ডেও তাই। আমরা সকলে বলি mother language; কিন্তু এর ভাষাবিজ্ঞানসম্মত নাম আছে। সেটা হলো native language। এটা আমাদের টপ্পার কবি রামনিধি গুপ্তের ‘স্বদেশীয় ভাষার’ই ইংরেজি নাম। তবে ‘মাতৃভাষা’র সম্পূর্ণ ব্যাপারটার সাথে মা এবং শিশুর সম্পর্ক আছে। ব্লুমফিল্ড এবং হরিচরণের সংজ্ঞা এভাবে তা স্মরণ করছেঃ শিশুরা চারপাশের লোকদের মতো কথা বলতে শেখে। মানব শিশুর এই প্রথম শেখা ভাষাটিই তার মাতৃভাষা বা native language।
সকলেই যে বলে, শিশুরা মায়ের কোলে শুয়েই এ ভাষা শিখতে শুরু করে, তা কি ঠিক?
বার্টান্ড রাসেল এর সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলছেন না, শিশুরা চিন্তা করতে পারে, কিন্তু ভাষা ব্যবহার করতে পারে না। সে বলে না বলে ফেলে; আর তার ফেলা যে ধ্বনি (ও কাকুধ্বনি)কে মা স্বাগত জানায়, সে ধ্বনিই শিশু বারবার উচ্চারণ করতে উৎসাহিত হয় । এসময় সে বাগধ্বনি উচ্চারণ করে না, তবে তা উচ্চারণের কায়দা-কানুন শিখতে শুরু করে। এটা এক সময় পূর্ণতা পায়। তাই বলতে হয়, এভাষা সে সাধারণভাবে মায়ের কাছে শেখে না, মায়ের কাছে শিখতে শুরু করে।
এখন কথা হলো, আমাদের এক মহান কথাসাহিত্যিক তাঁর মায়ের আঞ্চলিক ভাষায় একটি উপন্যাসের সমগ্র বয়ান দাঁড় করিয়েছেন;সংলাপ না, বর্ণনাও। এটা তিনি মায়ের দিকে তাকিয়ে করেছেন। এপ্রসঙ্গে আমার প্রশ্ন হলো, মায়ের ভাষাই কি মাতৃভাষা?
না, মোটেই না। আমরা অনেকেই বোবা মায়ের বাচাল ছেলে আছি না?
যাহোক, এখন, চমস্কির পরোক্ষ সহায়তা না নিয়ে আমাদের পক্ষে মাতৃভাষার সংজ্ঞা সাব্যস্ত করা অসম্ভব। এর প্রকৃত সংজ্ঞা হলোঃ সহজাত ক্ষমতা দিয়েই প্রথম শেখা যে ভাষার সমৃদ্ধ এবং বিকশিত রূপের চর্চা করা সম্ভব, তাকে বলে মাতৃভাষা।
বাংলার কোনও আঞ্চলিক ভাষা ‘যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং পরিপূর্ণরূপে বিকশিত না হলে’, সেটা আমার মাতৃভাষা হবে না; তাকে মাতৃভাষা বলা হলে তা ভাষাবিজ্ঞানসম্মতও হবে না। ‘আমার মাতৃভাষা বাংলা’ একথার নেতিবাচক অর্থ হলো, বাংলার কোনও উপভাষা তো নয়ই, কোনও আঞ্চলিক ভাষাও আমার মাতৃভাষা নয়, মাতৃভাষার সাথে তার যত ঘনিষ্ট সম্পর্কই থাক না কেন। (ভাষাশহিদ স্মরণে)
( লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)