বৈজয়ন্ত বিশ্বাস
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে একজন অদ্ভুতদর্শন লোককে ঝিনাইদহ শহরের বিভিন্ন জায়গাতে ঘুরতে দেখা যেতো। লোকটি বুদ্ধি ও বাক প্রতিবন্ধী। তার চেহারা কিছুটা রোহিঙ্গাদের মতো। দিনভর সে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতো; ক্ষুধা লাগলে শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে হাত পাততো। মুখ হাঁ করে, পেটে হাত দিয়ে নিজের অনুভূতি বোঝানোর চেষ্টা করতো। এতে রেস্টুরেন্ট মালিকরা সমস্যায় পড়ে যায়। কারণ কাস্টমাররা রেস্টুরেন্টের সামনে এমন একজন লোককে দেখলে সেখানে আবার নাও আসতে পারে। এটা নিয়ে তারা রেস্টুরেন্ট মালিকদের কাছে অভিযোগও করে। মালিকদের কেউ কেউ অনন্যোপায় হয়ে বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ সদর থানায় অভিযোগ করে। এরপর সদর থানা থেকে লোকটিকে হেফাজতে নিয়ে সংশ্লিষ্ট আমলে আদালতে উপস্থাপন করে সেফ কাস্টডির জন্য আবেদন করা হয়। তখন আদালত লোকটির পরিচয় সনাক্তকরণের জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আঙুলের ছাপ ম্যাচিংয়ের আদেশ প্রদান করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের কোনো ভোটারের সাথে তার আঙ্গুলের ছাপ মেলে কিনা এটা জানতে চাওয়া হয়। কার্টিজ পেপারে লোকটির আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগে প্রেরণ করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ লোকটির আঙ্গুলের ছাপ ম্যাচিং করতে ব্যর্থ হয় এবং আদালতকে অবহিত করে যে, কার্টিজ পেপারে সংগৃহীত আঙ্গুলের ছাপ দ্বারা এই ম্যাচিং সম্ভব নয়; তবে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে ডাব্লিউ.এস.কিউ পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা হলে ম্যাচিং করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন ডব্লিউ.এস.কিউ প্রযুক্তি মোটেই সহজলভ্য ছিল না। এজন্য সংশ্লিষ্ট অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিটিকে ঢাকা পাঠানোর প্রয়োজন হতো। যাহোক সেটা আর হয়ে ওঠেনি। লোকটির পক্ষে কেউ কখনো আদালতে শুনানিও করেনি। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ভিড়ে এই ব্যাপারটা সবার দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
এবার এই বিষয়টা কিভাবে আমার দৃষ্টিগোচর হলো সেটা বলি। আদালত সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গোড়া থেকেই আমি একটা সুঅভ্যাস গড়ে তুলেছি। সেটা হচ্ছে প্রত্যেক দিনের নথি সেটা যতো গুরুত্বহীনই হোক না কেন একবার হলেও উল্টেপাল্টে দেখা। ধার্য তারিখে এই নথি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। প্রায় তিন বছর লোকটি বিনা বিচারে জেলখানায় আটক আছে। কেউ তার খোঁজ নিতে আসেনি, কেউ তার পক্ষে কোনো কথা বলেনি। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, লোকটি কথা বলতে পারে না। সে মুখ দিয়ে এক ধরনের বোঝার অযোগ্য শব্দ করে বটে, তবে সেটাকে ঠিক ভাষা বলা যায় না। আর তর্কের খাতিরে সেটাকে যদি ভাষা বলে মেনেও নেওয়া যায়, তাহলেও সেটা যে ঠিক কোন ভাষা তা অজানা। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে আমি কয়েকটা যুক্তিপূর্ণ হাইপোথেসিস দাঁড় করালাম।
১. লোকটি যদি বাংলাদেশের নাগরিক হয় এবং কোনোভাবে যদি ভোটার তালিকায় তার নাম উঠে থাকে তাহলে ভোটারদের সাথে আঙ্গুলের ছাপ ম্যাচিং করলে তার নাম-ঠিকানার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এই বিষয়ে পূর্বেই আদালত উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার কারণে ঐ আদশের বাস্তবায়ন হয়নি।
২. লোকটি যদি রোহিঙ্গা হয় তাহলে বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে তার ছবি পাঠালে তার নাম-ঠিকানার খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।
৩. বাংলাদেশে মোট কয়টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প আছে এবং সেগুলো কার তত্ত্বাবধানে আছে তা জানা প্রয়োজন।
৪. লোকটাকে অবিলম্বে রোহিঙ্গা ভাষা বোঝে এরকম কারো সাথে ভিডিও কলে কথা বলানো যেতে পারে।
৫. আঙ্গুলের ছাপ ম্যাচিং করার জন্য অত্যাধুনিক ডিজিটাল ডিভাইস বা WSQ প্রযুক্তি বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলা নির্বাচন অফিসে আছে কিনা খোঁজ নিতে হবে।
৬. লোকটার নাম-ঠিকানার সন্ধান যদি কোনোভাবেই না পাওয়া যায় তাহলে তাকে জেলখানায় আসামীদের সাথে না রেখে সেফ হোম বা অন্য কোথাও রাখা সমীচীন হবে।
আমি আর দেরী না করে কক্সবাজারের টেকনাফ আমলী আদালতের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফোন করলাম। লোকটির ব্যাপারে বিস্তারিত বলার পর লোকটির সাথে কোনো দোভাষীর (যে বাংলা এবং রোহিঙ্গা উভয় ভাষা জানে) কথা বলিয়ে দিতে অনুরোধ করলাম। তিনি এ বিষয়ে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জকে দিকনির্দেশনা দেবেন বলে আমাকে কথা দিলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ আমাকে ফোন করল। আমি তাকে পরদিন সকাল ১০:৩০ টায় রোহিঙ্গা ভাষা বোঝে এমন কোনো বাঙালিকে টেকনাফ থানায় উপস্থিত রাখতে বললাম। এরপর অজ্ঞাতনামা লোকটিকে যথাসময়ে আদালতে উপস্থিত রাখার জন্য তার প্রতি পি.ডব্লিউ ইস্যু করলাম। সেই সাথে জেল সুপার, ঝিনাইদহকে চেম্বারে আমার সাথে দেখা করতে বলার জন্য বলতে সি.এস.আই এবং জিআরও-কে বললাম।
পরের দিন লোকটাকে যখন আমার সামনে হাজির করা হলো তখন আমি বেশ অবাক হলাম। এতদিন এভাবে জেলখানায় আটক থাকার ফলে তার যে মানসিক অবস্থা হওয়ার কথা তার কোনো লক্ষণ তার ভেতরে দেখলাম না। সে যেন বেশ আনন্দেই আছে এবং এই জীবনের সাথে নিজেকে অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে। যদিও তার চোখের দিকে ভালো করে তাকালে বোঝা যায় চোখের তারার গভীরে কোথায় যেন অব্যক্ত কোনো কথা, অগম্য কোনো দুঃখবোধের আভা! না বলা কষ্ট যেন তার মনের গহীনে গুম হয়ে বসে আছে!
আমি সময় নষ্ট না করে মূল কাজ শুরু করে দিলাম। অপর প্রান্তে দোভাষী প্রস্তুত ছিল। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে দুইজনের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের চেষ্টা ধৈর্য ধরে পর্যবেক্ষণ করলাম। দোভাষীটি এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলল, স্যার, লোকটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে রোহিঙ্গা হতে পারে; তবে আমি সিওর না।
আমি বুঝলাম অজ্ঞাতনামা লোকটি বাকশক্তির অধিকারী হলে এখনই নিশ্চিত হওয়া যেত সে রোহিঙ্গা কিনা। কিন্তু যেহেতু সে কথা বলতে পারে না সেহেতু এভাবে চেষ্টা করে এর চাইতে বেশি কোনো ফল লাভ হবে না। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম এমন একটা আদেশ দিতে হবে যাতে লোকটির সঠিক পরিচয়ের সন্ধান মেলে।
বলা বাহুল্য আমি ইতিমধ্যে বের করে ফেলেছি যে বাংলাদেশের মোট ৩৪ টা রোহিঙ্গা ক্যাম্প আছে এবং এগুলো দেখভাল করে বাংলাদেশ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। তিনটি থানায় এই রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো অবস্থিত। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এবং নোয়াখালীর ভাসানচর। ৪ টি এপিবিএন এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর দায়িত্বে আছে; এপিবিএন ৮, এপিবিএন ৯, এপিবিএন ১৪ এবং এপিবিএন ১৬। এগুলোর অফিস প্রধান পুলিশ সুপার পদের একজন কর্মকর্তা। ইতিমধ্যে আমি এটাও খোঁজ পেয়েছি যে আঙ্গুলের ছাপ ম্যাচিং করার মতো ডিজিটাল ডিভাইস বা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এখন ঝিনাইদহ জেলা নির্বাচন অফিসে আছে।
যাহোক আদেশের গর্ভে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিটি রোহিঙ্গা কিনা তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উক্ত এপিবিএন সমূহের পুলিশ সুপার এবং টেকনাফ, উখিয়া ও ভাসানচর থানার অফিসার ইনচার্জদেরকে নির্দেশ দিলাম। এই বিষয়ে তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য কক্সবাজার ও নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদেরকে নির্দেশনা দিলাম। লোকটির আঙ্গুলের ছাপ ম্যাচিং করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ঝিনাইদহের জেলা নির্বাচন অফিসারকে নির্দেশ দিলাম। লোকটির ছবি সহ আদেশের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পাঠালাম। ব্যক্তিগতভাবে আমিও তার ছবি এপিবিএন সমূহের পুলিশ সুপারদেরকে হোয়াটসঅ্যাপ প্রেরণ করলাম।
আদেশে স্বাক্ষর করা শেষ করে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলাম। নাম-পরিচয়হীন এই মানুষটার কষ্ট আমাকে মনে গাঢ় স্পর্শ বুলিয়ে গেছে। সৃষ্টিকর্তা যেন লোকটাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয় মনে মনে এই প্রার্থনা করলাম। মানুষটার মুখ বোবা হতে পারে, কিন্তু তার অন্তরটা কোনোভাবেই বোবা নয়। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হলেও সে আমার আপনার মতোই মানুষ। তাকে তার পরিচিত জনদের মাঝে ফিরিয়ে দেওয়া তার প্রতি দয়া দেখানো নয়; এটা আমাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতা।
সূত্র : বৈজয়ন্ত বিশ্বাস , অতিঃ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর ফেসবুক পেজ থেকে।