রেজাউল করিম
১৯৬২ সালেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সহায়তা চেয়ে চিঠি একটি দেন। চিঠিটি তিনি পাঠিয়েছিলেন ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের মাধ্যমে। ডেপুটি হাইকমিশনের পলিটিক্যাল অফিসার ছিলেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি। শশাঙ্ক ব্যানার্জির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় হয় ইত্তেফাক অফিসে মানিক মিয়ার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কাছে একটি চিঠি পাঠাতে চান। ব্যানার্জি কি কূটনৈতিক ব্যাগে তা পাঠাতে পারবেন? ব্যানার্জি বলেন, চিঠি পাঠানো যাবে, তবে তার আগে দূতাবাসের দু’জন অফিসার তা দেখবেন। বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, অফিসার দু’জন কে? পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে ব্যানার্জির পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়। তবুও শেখ মুজিবকে নাম দু’টি বললেন। তাদের একজন ঢাকায় নিযুক্ত ডেপুটি হাইকমিশনার সূর্য কুমার চৌধুরী, অপরজন ঢাকায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান কর্নেল এস. সি. ঘোষ। তারপর তা প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে যাবে, তবে চিঠির কপি যাবে পররাষ্ট্র সচিব ও গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের কাছে। বঙ্গবন্ধু চিঠিটি ব্যানার্জির কাছে হস্তান্তর করলেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন আবাসভূমি গঠন করতে চান। এ জন্য তিনি প্রথমে ভারতে যাবেন, তারপরে ভারত থেকে লন্ডন যাবেন। সেখানে ঘাঁটি গেড়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করবেন, বিশ্ব জনমত গড়ে তুলবেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু যেমনটা করেছিলেন।
চিঠিটি সাইফারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের নিকট ভারতের পরাজয়ের পর নেহরু বিষণ্ণ মনেই থাকতেন। তারপরেও শেখ মুজিবের চিঠি তাঁর মনে আগ্রহের সৃষ্টি করে। তিনি তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের বৈঠক ডাকলেন। আরো কয়েকজনের সঙ্গে তিনি পুরো বিষয়টির খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। তারা তখন দেশের বাইরে ছিলেন। সুতরাং একটু সময় লাগবে। নেহরু নির্দেশ দিয়েছিলেন, মুজিবকে যেন জানানো হয় তাঁর প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এসেছে এবং খুব শিঘ্রই এ বিষয়ে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাবেন। দিল্লি থেকে সহসা প্রতিক্রিয়া না আসায় শেখ মুজিব ধৈর্যহারা হয়ে উঠলেন। তিনি মনে করলেন, ঢাকা মিশনের আমলারা ইচ্ছা করে জটিলতা সৃষ্টি করছেন। তখন শেখ মুজিব ভাবলেন, আমলাদের চেয়ে রাজনীতিবিদরা বিষয়টি ভালো বুঝবেন। তিনি রাজনীতিবিদ শচীন্দ্র লাল সিংহের দ্বারস্থ হলেন। পরবর্তীকালে শচীন্দ্র লাল ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। একপক্ষ শেখ মুজিবকে ত্রিপুরা হয়ে ভারতে যাওয়ার কথা বলেন। আরেক পক্ষ অপেক্ষা করতে বলেন। বিষয়টি নিয়ে তালগোল পেকে য়ায়। ফলে, শেখ মুজিব ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বঙ্গবন্ধু মনে মনে এ সিদ্ধান্ত এঁটেছিলেন যে, ভারত তাঁকে সাহায্য না করলে তিনি বার্মা ও চীনের সহযোগিতা চাইবেন। ১৯৬২ সালে তিনি জেল থেকে বের হলেও তাঁর উপর সরকারের অন্তরীণাদেশ ছিল। তাই ঢাকার বাইরে যাওয়া তাঁর জন্য ছিল কঠিন। অতি গোপনে ছদ্মবেশে তিনি কুর্মিটোলা, টঙ্গী, কুলাউড়া দিয়ে কখনো গাড়িতে, কখনো ট্রেনে, কখনো পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা পৌঁছেন। তাঁর অন্তর্ধান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেন- রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী (যিনি ছিলেন সিলেটের একজন চা বাগান মালিক) এবং জাঁদরেল আমলা দত্ত চৌধুরী। কিন্তু এ মিশন সফল হলো না। আগরতলা গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন। সেখানে তিনি একদিন জেলে ছিলেন। সেখানে তাঁকে ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করা হলে তিনি বলেন, “আমাকে গ্রেফতার কেন? আমার জন্য তো প্লেন প্রস্তত থাকার কথা।” বিষয়টি ত্রিপুরা প্রশাসনের জানা ছিল না বা কেন্দ্র থেকে তাদেরকে অবহিত করা হয়নি। ফলে আগরতলা থেকে শেখ মুজিব ব্যাক করেন। আগরতলা থাকতেই দিল্লি থেকে শেখ মুজিবকে জানানো হলো, উত্তর দিতে দেরি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমাপ্রার্থী। নেহরু বলেছিলেন, একটি চ্যানেলের মাধ্যমে তাঁকে কাজ করতে হবে। আর তা হচ্ছে ঢাকার ডেপুটি হাইকমিশন মিশন, আগরতলা নয়। তিনি শেখ মুজিবকে ত্রিপুরায় অবস্থান করে প্রচার করতে দিতে সম্মত হননি। চীনা অভিযানের পর তিনি এতবড় ঝুঁকি নিতে চাননি। তবে নেহরু আরো জানান যে, ভারত তাঁকে সমর্থন দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ঢাকার মিশনকে তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে আগরতলা থেকে শেখ মুজিব ব্যাক করেন।
বঙ্গবন্ধুর চিঠির উত্তরে জওহরলাল নেহরু যা লিখেছিলেন তা যেন ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের একটি সমঝোতা স্মারক। এতে ছিল উপদেশ, শর্ত, করণীয়, প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারনামা। প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের সংবিধান, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য সম্পর্কে। এ মূল্যবোধ হলো ঔপনিবেশের বিরুদ্ধে স্বাধীকার সংগ্রামকে সমর্থন করা। তবে যাঁরা স্বাধীকার ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন, প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি এবং শ্রদ্ধা থাকতে হবে পরস্পরের জাতীয় বা সভ্যতার আইডেনটিটির প্রতি। এসব বিষয়ে একমত হলে ভারত সব ধরনের সহযোগিতা দেবে। তবে, অত্যন্ত গোপনে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে উভয়পক্ষ অস্বীকার করতে পারবে। ভারত পরামর্শ দিয়েছিল, শেখ মুজিব যেন বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে বেশি তাড়াহুড়া না করে। কেননা, তাতে পদস্খলনের সম্ভাবনা থাকে। তাঁকে এ-ও বলে দেয়া হলো, লন্ডন যাত্রায় কোনো লাভ হবে না। অপারেশনাল বেসে নেতৃত্ব না থাকলে তা কার্যকর হবে না। মুজিবকে সব সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধুকে এই বলে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল যে, তিনি যেহেতু গণতন্ত্রের কথা বলছেন, সেহেতু সে গণতন্ত্রের চেতনা তৃণমূলে বিকশিত করতে হবে। স্বাধীনতার পথ কন্টকাকীর্ণ। এ পথ অতিক্রম করার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আর সে পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমেই তাঁর নেতৃত্ব পরীক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে। বলা হয়েছিল, যখন তাঁর বক্তৃতা শুনতে লক্ষ লোকের সমাগম হবে, তখনই বিশ্ব স্বীকার করে নেবে তিনি গণমানুষের নেতা। তাঁর মুখপাত্র হিসেবে একটি পত্রিকা থাকতে হবে, যেটি আদর্শের জায়গাটা ধরে রেখে গণসচেতনতা সৃষ্টি করবে। শেখ মুজিব ও তাঁর দলের এমন একটি পত্রিকা ও একজন সম্পাদক থাকায় ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁরা আরো বলেছিলেন, চাইলে ভারত পরামর্শ দিতে পারে, কীভাবে আওয়ামী লীগের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। দ্বারে দ্বারে গিয়ে সামান্য চাঁদা তুলে পার্টির ফান্ড গড়তে হবে। যখন লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে, তখন ভারত কৌশলগত সব ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা দেবে। তবে বিপ্লব করার দায়িত্ব একমাত্র মুজিব এবং আওয়ামী লীগের, আর কারো নয়। ভারতীয় নীতি নির্ধারকেরা আরেকটি বিষয়ের কথা ভাবছিলেন, তা হলো অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে। তবে পাকিস্তানের মতো হিংস্র শাসকদের বিরুদ্ধে তা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে তাঁরাও সন্দিহান ছিল। তবে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলা হয়েছিল।
ভারত যে আদর্শের কথা শেখ মুজিবকে বলেছিল, তা শেখ মুজিব নিজেই ধারণ করতেন- তা তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লেই জানা যায়। যে ধরনের কৌশলের কথা ভারত তাঁকে বলেছিল, তা তাঁকে অনুসরণ করতেও দেখা যায়। সেটা নিজের কেীশলও হতে পারে বা ভারতের পরামর্শেও হতে পারে। এরপর থেকে তিনি স্বাধীনতা নিয়ে তাড়াহুড়া করতে চাননি। তিনি ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছেন। তিনি কর্মসূচি দিয়েছেন, মানুষকে সচেতন করেছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন, দলকে তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠিত করেছেন। তাঁর জনসভায় লক্ষ লক্ষ লোক সমাগম হতো। তিনি ছিলেন সুবক্তা। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাঁর বক্তৃতা শুনত। তিনি হয়েছিলেন গণমানুষের দেবতা। তিনি আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী দলে রূপান্তরিত করেছিলেন। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন তারই প্রমাণ। সে নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগ বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করে। তারপরও যখন তাঁকে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করছে না, তখনো তিনি ধৈর্যহারা হননি, একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তিনি অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। ৭ মার্চের ভাষণ শোনার জন্য সেদিন ঢাকায় ২০ লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছিল। সেদিন তিনি যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, স্বাধীনতাও ঘোষণা করতে পারতেন। সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য তাঁর উপর ছাত্র-জনতার চাপও ছিল। সেদিন তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণাও করেননি, আবার বাদও রাখেননি। সেদিন তিনি স্বাধীনতার জন্য জনগণকে প্রস্তত হওয়ার দিক নির্দেশনা দিলেন। তিনি জানতেন আলোচনা ব্যর্থ হবে। তবুও তিনি আলোচনা করলেন। আলোচনা ব্যর্থ হলো। পাকিস্তানিরা অকস্মাৎ বাঙালিদের উপর আক্রমণ শুরু করল। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। এ সবই ছিল তাঁর রাজনীতির চরম পরিপক্কতা। যার জন্য ভারত তাঁর উপর আস্থা রাখতে পেরেছিল এবং ভারত তার প্রতিশ্রুত সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়েছিল। জওহরলাল নেহরু ১৯৭১ সালে জীবিত ছিলেন না, তিনি ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তবে তাঁর কন্যা প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পিতার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পিছপা হননি।
আরেকটি কথা উল্লেখ করা যায়- তা বলেছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক, বাংলা পিডিয়ার প্রধান সম্পাদক, ডঃ সিরাজুল ইসলাম। স্যার বলেছিলেন, তাঁর কাজিন, নাম এ. কে. রফিকুল হোসেন ছিলেন শেখ মুজিবের বন্ধু। রফিকুল হোসেন ১৯৫৪ সনের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেখ মুজিব মাঝে মাঝে স্যারদের বাসায় যেতেন এবং তাঁর ভাইয়ের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। তখনই শেখ মুজিব বলতেন, এ পাকিস্তান দিয়ে কাজ হবে না। এটাকে ভেঙ্গে ফেলতে হবে এবং পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করতে হবে। এসব শুনে স্যার তখন ভীষণ কষ্ট পেতেন। কেবল পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে, আর এরা এখনই একে ভেঙ্গে ফেলতে চায়। স্যার তখন স্কুলে পড়তেন, পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণিতে।
বিশিষ্ট কম্যুনিস্ট নেতা ও লেখক খোকা রায়ের মতে, শেখ মুজিব ১৯৬১ সাল থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি তাঁর ‘সংগ্রামের তিন দশক’ গ্রন্থে এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। ১৯৬১ সালের শেষের দিকে আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের সঙ্গে শেখ মুজিবের কয়েকটি গোপন বৈঠক হয়। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সূচনা করার কৌশল নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। কমিউনিস্ট নেতাদের তিনি একাধিকবার বলেন, গণতন্ত্র, বন্দি-মুক্তি প্রভৃতি দাবির সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতার দাবিও এখনই ওঠানো উচিত। তাঁরা বললেন, এখনো সময় আসেনি। জনগণকে প্রস্তুত করেই চূড়ান্ত সংগ্রামে নামতে হবে। এখন গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে ছাত্রদের মধ্য থেকে আন্দোলন শুরু করতে হবে। তিনি বললেন, আমার নেতা শহীদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁর চিন্তাধারা আপনাদের মতই। আপনাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম, যুক্তিগুলো মানতে পারলাম না। তবে স্বাধীনতাই আমার শেষ কথা। বঙ্গবন্ধুর আপাদমস্তক চিন্তাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী লন্ডন যান চিকিৎসার জন্য। ’৬৩ এর নভেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু লন্ডন যান তাঁর প্রিয় নেতার দেখাশোনা ও পার্টির পুনরুজ্জীবনের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে। লন্ডনে বাঙালিদের আড্ডার স্থল আর্লস কোর্ট এলাকায় ‘গ্রিনমাসক’ রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্ন ভোজন করছেন গুরু-শিষ্য (সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব)। খাবার তদারক করছেন রেস্টুরেন্টের মালিক প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নান সানু মিয়া। শেখ মুজিব বললেন, “স্যার, আপনিই হউন আর মওলানা সাহেবই (মওলানা ভাসানী) হউন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী, আপনারা কোনো অবস্থায়ই ইস্ট পাকিস্তানকে বাঁচাতে পারবেন না। কারণ ওয়েস্ট পাকিস্তান ইস্ট পাকিস্তানকে গিলতে বসেছে। ইস্ট পাকিস্তানকে একদিন না একদিন আলাদা হতেই হবে। স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। এ কথা শুনে সোহরাওয়ার্দী রেগে যান এবং বলেন, ‘Don’t talk nonsense’, শেখ মুজিব চুপ করে গেলেন। একটু সামলে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী বললেন, তোমাদের কী আছে যে আলাদা হয়ে যাবে? পারবে ওদের সাথে যুদ্ধ করে আলাদা হতে? ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর গুরুর সে প্রশ্নের উত্তর শিষ্য ঠিকই দিয়েছেন। আসলে শেখ মুজিবের সারা জীবনের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনাই ছিল বাংলার স্বাধীনতা।
[রেজাউল করিম, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তা, গ্রন্থ কুটির, পৃ. ১৪৬-১৫১০]।
লেখক•সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।