ডাঃ শওকত আরা বীথি:
জীবনে চলার পথে কতভাবেই না আমরা মানসিক চাপ বা পীড়নের শিকার হই সেকথা বলে শেষ করা কঠিন। বিয়োগ বিচ্ছেদের বড় বড় করুন ঘটনা ছাড়াও ছোট ছোট বিরক্তিকর বিষয় নানাভাবে আমাদেরকে এমন উত্যক্ত করে যে দৈনন্দিন জীবনও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। সামাজিক,পারিবারিক এমনকি ব্যক্তিক জীবনে বড় বড় ঘটনা বা দুর্ঘটনা মানসিক পীড়নের ঘুর্নিপাকে ফেলে দেয় আমাদের জীবনকে ।যেমন স্বামী স্ত্রীর যে কোন একজনের মৃত্যু, বিবাহবিচ্ছেদ, আকস্মিক বিপুল আর্থিক সর্বনাশ বা চাকরী খোয়ানো,গভীর চারিত্রিক অপবাদ বা কলঙ্ক ইত্যাদি।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন উল্লিখিত বড় বড় ঘটনা গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু সময় ক্রমশঃ সেখানে পলি ফেলে দিয়ে এর তীব্রতা কমিয়ে এনে এমন অবস্থা সৃষ্টি করে যে একসময় আঘাতের সবটাই মাটিচাপা পড়ে যায়। স্থায়ী ক্ষত দীর্ঘকাল ধরে রক্ত ঝরাবার অবকাশ পায়না। অবশ্য অবস্থা বিশেষে এর ব্যতিক্রমও ঘটে কিন্তু ছোট ছোট ঘটনার ধিকিধিকি জ্বালাও পরিণামে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে থাকে।
তাই, চাকরী হারানো বা আপন জনের মৃত্যুর মত কঠিন আঘাতের মত ঘটনার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া সরাসরি মনে বা দেহে যত না প্রভাব ফেলে তার চেয়ে অনেক বেশী স্থায়ী পীড়নের কারণ হয়ে ওঠে। যেমন প্রতিদিনের জীবনে ঘরে বিরূপ পরিবেশের স্থায়ী অবস্থান যথা স্বামী স্ত্রীর বা পরিবারের সদস্যদের বিরস সংলাপ,তির্যক কথাবার্তা এমনকি নিজের মনেও নেমে আসা পরিবর্তনেও মানসিক পীড়নের কারণ ঘটে। এছাড়া কর্মস্থলে অনিশ্চয়তা,যানবাহনের সমস্যার ফলে অফিসে নিত্য গরহাজিরা আর উপরওয়ালার রক্তচক্ষু হজম করা,জিনিসপত্রের নিত্যকার দাম বাড়ার মধ্য দিয়ে বাজারে গিয়ে নিয়মিত রক্তচাপবৃদ্ধি, এইসব ছোট ছোট অতি সাধারণ ঘটনাও কম যায়না। আবার মনেক সময় অফিসের বড় কর্তার হুকুমে নির্দিষ্ট একটি সময়ে কোন কাজ শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয় অথচ ঐ সময়ের মধ্যে কাজটি শেষ করা সম্ভব নয়।সেসব ক্ষেত্রে লাগাতার পীড়ন কাউকে না কাউকে চাপা যন্ত্রণায় ক্ষয় করতে থাকে। আবার এর চেয়ে অনেক হাল্কা কারণ,কারো চোখে অতি তুচ্ছ বিষয়ও অনেক সময় মনকে উত্যক্ত করার ক্ষমতা রাখে। সারাক্ষণ চড়া আওয়াজ বা গন্ডগোলও এমন সব তালিকায় পড়ে। এবং দেহমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে থাকে কোন কোন ক্ষেত্রে।
লস এঞ্জেলসের বিমান বন্দরের একেবারে কাছাকাছি বসবাসকারীদের মধ্যে এক সমীক্ষা চালিয়ে এমনটি দেখা গেছে।
এইসব ছোটখাট উপদ্রব সৃষ্টিকারী ঘটনা শুধু মনেই নয় দেহের উপরও দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে। এমনকি চড়াহারে সুদ আদায় করতে থাকে। দেহযন্ত্রের জটিল ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যদিয়ে রক্তে ক্রমাগত চুঁইয়ে পড়তে থাকে বিভিন্ন ধরনের হরমোন,রাসায়নিক পদার্থ যেমন এ্যাড্রিনালিন,নর এ্যাড্রিনালিন ,কর্টিসোন আরও কত কি! আর দীর্ঘদিন ধরে এগুলির প্রভাব দেহের বিশেষ বিশেষ অঙ্গে সৃষ্টি করে গভীর রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার স্থায়ী ক্ষত। দেখা দিতে পারে পেপটিক আলসার, করোনারী হৃদরোগ,উচ্চ রক্তচাপ বা ব্লাডপ্রেসার, উদ্বেগ,উৎকন্ঠা, বিষন্নতা,এমনকি কখনো বা ডায়বেটিসসহ আন্ত্রিক গোলযোগের মত রোগ। বিষয়টি বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন বৈ কি!
(চলবে)
(ভূতপূর্ব চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার,এপিডেমি ওলজী, আই,ই, ডি, সি,আর,স্বাস্হ্য অধিদপ্তর,মহাখালী,ঢাকা।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।)