মুহম্মদ রবীউল আলম:
মেহেরপুরের ভাষা আন্দোলনে মেহেরপুরের বাসস্ট্যান্ড পাড়ার গোলাম কবির খান গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। তিনি সে সময়ে মেহেরপুর উচ্চ ইংলিশ হাই স্কুলের ছাত্র। তিনি ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ-সমাবেশসহ পরবর্তীতে বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনে ভূমিকার কারণে তাকে সহ ৭জন ছাত্র স্কুল থেকে বহিষ্কার ও গ্রেফতার করা হয়। আজ ১২ মার্চ ভাষা সৈনিক গোলাম কবির খানের ২০ তম প্রণয় দিবস।
প্রথম আলো (০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) পত্রিকায় বিশিষ্ট ভাষা আন্দোলনের গবেষক আহমদ রফিক মেহেরপুরের উত্তাল দিনগুলি শীর্ষক লেখায় গোলাম কবির খানের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ১৯৫৫ সালে শহীদ দিবস উদ্যাপনকালে আবুল কাসেম, নজীর হোসেন, সামসুল আলা, কদম রসুল, ইসমাইল হোসেন, মোসারফ হোসেন ও গোলাম কবির খানকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে অবশ্য শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তদবিরে ওই বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়েছিল।
২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় ইসমাইল তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শীর্ষক প্রতিবেদনে বার বার গোলাম কবির খানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লেখা হয়’ ২১শে ফেব্রুয়ারির মিছিলে পুলিশের গুলির খবর মেহেরপুরে পৌঁছায় পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি। ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবাদ-সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। আবুল কালামের সভাপতিত্বে কালাচাঁদ মেমোরিয়ালের সামনে সমাবেশ হয়। ওই দিন মেহেরপুর উচ্চ ইংরেজি মডেল বিদ্যালয়ের মুসলিম হোস্টেলের ছাত্ররা পোস্টারিং, পিকেটিংসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। মুন্সী সাখাওয়াত হোসেন, বঙ্কা ঘোষ, শান্তি নারায়ণ চক্রবর্তী, গোলাম কবির খান, মহর আলী, আবুল কাশেম, ইসমাইল হোসেন, নজির হোসেনসহ প্রায় ১০-১১ জন ছাত্র শহরে মিছিল বের করেন। তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে ব্যবসায়ীরাও দোকান বন্ধ করে দেন। শহরজুড়ে থমথমে অবস্থা ছিল। ভাষার দাবিতে পুরো ফেব্রুয়ারিজুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। ইসমাইল তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।
পরের বছর ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন উপলক্ষে মিছিল ও সমাবেশ করেন ভাষাসংগ্রামীরা। পুলিশ তাঁদের মিছিলে লাঠিপেটা করে এবং ইসমাইল হোসেনসহ সাতজনকে আটক করে। পরে সন্ধ্যার দিকে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালেও ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করেন। ১৯৫৫ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন পাকিস্তান সরকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে। ইসমাইল হোসেনরা সেই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ভাষার দাবিতে পোস্টারিং, মিছিল ও মিটিং করে। পুলিশ তাঁদের মিছিলে লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে অনেক ছাত্র আহত হন। ওই দিন রাতে ইসমাইল হোসেনসহ সাতজনকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। বাকিরা হলেন—নজির হোসেন, সামসুল হুদা, কদম রসুল, আবুল কাশেম, গোলাম কবীর খান ও মোশারফ হোসেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁরা আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি স্কুল কমিটি মিটিং করে তাঁদের সাতজনকে ফোর্সড টিসি দেয়। সেই থেকে লেখাপড়ার পাট চুকে যায় ইসমাইল হোসেনসহ ওই সাতজনের।
তোজাম্মেল আযম তার মেহেরপুর জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য গ্রন্থে লিখেছেন,১৯৫৪ সালে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেন।১৯৫৫ সালে ভাষা দিবস উদযাপনের জন্য মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ প্রহরা বসায়। এক পর্যায়ে পুলিশ সরে গেলে ১২ থেকে ১৫ জন ছাত্র ব্যাজ ধারণ করে মিছিল বের করে। মিছিলে রিপন বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের করেকজন অংশ গ্রহণ করে। প্রশাসনের রক্তচোখ উপেক্ষা করে ছাত্র-ছাত্রীর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে স্লোগান দিয়ে মিছিলটি শহর প্রদক্ষিণ করে। এই মিছিলের ফলাফল হয় কয়েকজন ছাত্রের জন্য ভয়াবহ। ভাষা দিবস উদযাপনের জন্য মডেল স্কুলের ৭ জন ছাত্রকে রাসটিকিট দেয়া হয়। এরা হলেন শামসুল আলা, গোলাম কবির, আবুল কাশেম আঙ্গুর, নজীর হোসেন, কদম রসুল ও ইসমাইল হোসেন। এই রাসটিকিট প্রদান মেহেরপুরের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচন্ড ঝড় তোলে।
গোলাম কবির খানের ভাগ্নিনা কবি নজমুল হেলাল ও শ্যালক আযম খান দীপু জানান, ভাষা সৈনিক গোলাম কবির খান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)-এর কর্মকর্তা ছিলেন। তার বাবা সৈয়দুর রহমান খান জমিদারের নায়েব ছিলেন। মেহেরপুরের কাথুলী রোডে তার ৪০ বিঘা জমির ওপর আম বাগান তার স্মৃতিকে এখনো ধরে রেখেছে। যা নায়েব বাগান হিসেবে পরিচিত। তারা ১০ ভাই ৪ বোন ছিলেন। শিশুকালে ৩ ভাই মারা যায়। বেঁচে ছিলেন ৭ ভাই ৪ বোন। গোলাম কবির খান বাবার ৪র্থ সন্তান। বাকিরা হলেন, গোলাম মোস্তফা খান, ভাষা সৈনিক গোলাম গাউস খান, গোলাম এহিয়া খান, আতিয়ার রহমান খান, মতিয়ার রহমান খান লালু,গোলাম আলী খান ছুটু। গোলাম কবির খানের স্ত্রী মেহেরপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে সাবেক জনপ্রিয় শিক্ষক আক্তার খানম মিনা। ৩ মেয়ে ও ১ ছেলে। মেয়ে সুমনা খানম লীনা (স্বামী মেহেরপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোঃ মখলেছুর রহমান), প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক রুমানা খানম ও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ফারহানা খানম। ছেলে মিজানুর রহমান অনু ব্যবসায়ী। গোলাম কবির খান ২০০২ সালে এবং তার স্ত্রী শিক্ষক আক্তার খানম মিনা ২০০০ সালে ইন্তেকাল করেন।
ছবি-কবি নজমুল হেলাল