মুহম্মদ রবীউল আলম:
মেহেরপুরের ভাষা আন্দোলনে মেহেরপুরের শালিকা গ্রামের আওলাদ হোসেনের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। তিনি সে সময়ে মেহেরপুর উচ্চ ইংলিশ হাই স্কুলের ছাত্র। আওলাদ হোসেন, কামাল আহমেদ, আমানুল ইসলাম, জান মোহাম্মদ ও আবদুস সাত্তার ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে মেট্রিক পরীক্ষা দেন। পরীক্ষার আগে তারা এই আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ধর্মঘটে তারা অংশ নেন। আওলাদ হোসেন তখন ৭ম শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি মর্মান্তিক ঘটনা মেহেরপুরে পৌঁছান জগন্নাথ কলেজের ছাত্র মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী আব্দুল মতিন (উকিল)। তিনি মেহেরপুরে এসে ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলনে শরিক হন। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান বিতর্কিত। মেহেরপুরে ২২,২৩ ও ২৪ তারিখে ধর্মঘট পালিত হয়।ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারেণে আওলাদ হোসেন শালিকা গ্রামে মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীদের হাতে নির্যাতিত হন। তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। তিনি পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান। তিনি মেহেরপুর উচ্চ ইংলিশ হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। পরে তিনি তার বন্ধু ভাষা সৈনিক আমানুল ইসলামের সাথে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু পারিবারিক কারণে তিনি পড়াশুনা আর করতে পারেন নি। পরবর্তীতে তিনি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং শেষে মেহেরপুরের শালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার বাবা রইসউদ্দিন বিশ্বাস। তারা এক ভাই এবং এক বোন। তার বিয়ে হয় মোছাঃ মনোয়ারা বেগমের সাথে। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ ভুমিকা রাখেন। তিনি মেহেরপুর সীমান্ত সংলগ্ন খালপাড়া বালুর মাঠ ক্যাম্পে শরনার্থীদের সাথে ছিলেন। তার ১২ সন্তান। ৪ ছেলে ও ৮ মেয়ে। তার ছেলেরা সকলেই প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে মোফাজ্জেল হোসেন মেহেরপুরে ভকেশনাল ইন্সিটিটিউটের গণিত বিভাগের শিক্ষক। পরবর্তী ছেলেরা হলেন মোল্লা মটরস মেহেরপুর শো রুমের মালিক মোঃ তোফাজ্জেল হোসেন, তরুণ কথাসাহিত্যিক-লেখক বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা মোঃ মোজাফফর হোসেন এবং ছোট ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রাপ্ত মোঃ খালিদ মোশররফ।
আওলাদ হোসেন মেহেরপুর স্টেডিয়ামপাড়ায় বাড়ি করেছিলেন। মেহেরপুরের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাবুয়া বোসের সাথে তার সম্পর্ক ছিল গভীর। জননেতা মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন, শিক্ষক শিব নারায়ণ বাবু, শিক্ষক জান মোহাম্মদ, ভাষা সৈনিক আমানুল ইসলাম, ননী গোপাল ভট্টাচার্য,ইসমাইল হোসেনসহ অন্যদের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল।
প্রথম আলো (০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) পত্রিকায় বিশিষ্ট ভাষা আন্দোলনের গবেষক আহমদ রফিক মেহেরপুরের উত্তাল দিনগুলি শীর্ষক লেখায় আওলাদ হোসেনের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, মুন্সী সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে আওলাদ হোসেন, কাওসার আলী, ইসমাইল হোসেনসহ মেহেরপুর স্কুলের ছেলেরা পোস্টারিং, পিকেটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি একটি মিছিল শহর প্রদক্ষিণকালে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেও তা ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি। ওই দিন আবুল কালামের সভাপতিত্বে কালাচাঁদ হলের সামনে সমাবেশ হয়। সমাবেশে সরকারের নীতিনির্ধারণের সমালোচনা ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তাঁরা বক্তব্য রাখেন।’
মেহেরপুরের ভাষা সৈনিক গোলাম কাউসার চানা মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় (১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) এক সাক্ষাৎকারে আওলাদ হোসেনের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, সেদিন শিক্ষার্থী মুন্সি সাখাওয়াৎ হোসেন, জান মোহাম্মদ,আবুল হোসেন, সুলতান শেখ, ইসহাক বিশ্বাস, দেওয়ান ইয়ারুল ইসলাম, গোলাম গাউস খান, আওলাদ হোসেন, মীর মোজাম্মেল হক, রফেজ উদ্দীন মল্লিক রতন, সিরাজুল ইসলাম, শান্তি নারায়ণ, ইউনুস আলী, মকছেদ আলী, বংকু ঘোষ ওরফে সতীনাথ ঘোষ, সাদেক আলীসহ অনেক শিক্ষার্থী মিছিল করে। মিছিলটি তৎকালীন রিপন ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় অতিক্রম করে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
সৈয়দ আমিনুল ইসলাম রচিত মেহেরপুরের ইতিহাস গ্রন্থে ভাষা সৈনিক আওলাদ হোসেনের কথা লেখা আছে। তিনি লিখেন, মেহেরপুরে মহান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহনকারীর সংখ্যা ১৬ জন। তারা হলেন, মুন্সি সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক প্রধান শিক্ষক কবি কাজী নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল, মেহেরপর। গোলাম কাওসার (চানা) ওরফে কাওসার আলী চানা, সাবেক পৌর কর্মচারী, মেহেরপুর। জান মোহাম্মদ, সাবেক সহকারী শিক্ষক সরকারী উচ্চ বালক বিদ্যালয়, মেহেরপুর। আবুল হোসেন, থানা রোড মেহেরপুর। সুলতান উদ্দিন সেখ, কালাচাঁদপুর, মেহেরপুর। ইছাহক বিশ্বাস, খন্দকার পাড়া, মেহেরপুর। সিরাজুল ইসলাম, বাওট, গাংনী, মেহেরপুর। গোলাম গাউস খান, বাসষ্ট্যান্ডপাড়া, মেহেরপুর। আওলাদ হোসেন, শালিকা, মেহেরপুর। মীর মোজাম্মেল, মীরপাড়া, আমঝুপি, মেহেরপুর। রফেজ উদ্দিন মল্লিক রতন, পিরোজপুর, মেহেরপুর। শান্তিনারায়ণ চক্রবর্তী, কাশ্যবপাড়া, মেহেরপুর। বংকু ঘোষ ওরফে সতীনাথ ঘোষ, কালীবাজার, মেহেরপুর। ইউনুচ আলী, কোমরপুর, মেহেরপুর। সাদেক আলী, কাঁশারীপাড়া, মেহেরপুর ও দেওয়ান ইয়ারুল ইসলাম, গড়পাড়া,মেহেরপুর।
( লেখক – সিনিয়র সাংবাদিক ও সাপ্তাহিক মুক্তিবানীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক)